বর্তমান সময়ে দেশি মুরগি পালন একটি লাভজনক ও সহজলভ্য উদ্যোগ। বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে মুক্তভাবে মুরগি পালন সম্ভব, এটি সাধারণ মানুষের বিশেষ করে গৃহিণী ও বেকার যুবকদের আয়ের একটি অন্যতম উৎস হতে পারে। একটি ছোট মুরগির খামার গড়ে তোলার জন্য ৫ টি দেশি মুরগি এবং ১ টি দেশি মোরগ যথেষ্ট। এই ধরনের পালন ব্যবস্থা শুরু করতে খুব বেশি পুঁজি বা জায়গা লাগে না, কিন্তু সঠিক যত্ন এবং পর্যাপ্ত খাবারের যোগান নিশ্চিত করতে পারলে তা ভালো একটি লাভের রাস্তা খুলে দিতে পারে।
দেশি মুরগির বৈশিষ্ট্য
দেশি মুরগি খুবই পরিশ্রমী ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রাণী। এদের যত্ন কম লাগে এবং খাবারের ব্যাপারে এরা সহজে মানিয়ে নিতে পারে। দেশি মুরগি সাধারণত ছোটখাটো, তবে তাদের ডিমের উৎপাদন ক্ষমতা ভালো এবং ডিমের স্বাদ বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদের মাংস উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং সব জায়গাতে চাহিদা বেশি থাকে।
৫ টি দেশি মুরগি এবং ১ টি দেশি মোরগ কেন নির্বাচন করবেন?
- কম পরিসরে পালন সুবিধা: মাত্র ৫ টি মুরগি এবং ১ টি মোরগ পালনের জন্য কম পরিসরেই প্রয়োজনীয় জায়গা তৈরি করা যায়।
- কম খরচে শুরু: দেশি মুরগির জন্য খাদ্য খরচ কম লাগে এবং তাদের অধিকাংশ খাবার সহজেই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা যায়।
- উচ্চ মানের ডিম ও মাংস: দেশি মুরগির ডিম ও মাংসের পুষ্টিমান বেশি এবং বাজারে এর দামও ভাল পাওয়া যায়।
- মুক্তভাবে পালন সহজ: দেশি মুরগি সহজেই মুক্তভাবে পালন করা যায়, এতে তাদের খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং খরচও কমে।
দেশি মুরগি পালনের সুবিধা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: দেশি মুরগি অন্যান্য মুরগির চেয়ে রোগ প্রতিরোধে বেশি সক্ষম। ফলে এদের মধ্যে রোগবালাই কম হয়।
- স্বল্প বিনিয়োগে ভালো মুনাফা: দেশি মুরগি পালনে খুব বেশি খরচ হয় না এবং প্রতিদিন ডিম পেলে তা বিক্রি করে ছোট ছোট লাভ ঘরে আনা সম্ভব।
- ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি: ৫ টি মুরগি পালনে গড়ে প্রতিদিন ২-৩ টি ডিম পাওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে মাস শেষে ভালো আয়ের সুযোগ থাকে।
দেশি মুরগি ও মোরগের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
দেশি মুরগির খাদ্য তালিকায় মূলত সহজলভ্য জিনিসগুলোই থাকে, যেমন—ধানের কুঁড়ো, গম, ভুট্টা, এবং বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি। এতে খাবারের খরচ অনেক কমে যায় এবং মুরগি সহজেই তা হজম করতে পারে। তবে সপ্তাহে অন্তত একবার পুষ্টিকর খাদ্য যেমন গুঁড়া বা বিশেষ খাবার দেওয়া উচিত, যা মুরগির স্বাস্থ্য এবং ডিম উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।
- ধানের কুঁড়ো, ভুট্টা ভাঙ্গা ও গম: ধানের কুঁড়ো, ভুট্টা ভাঙ্গা এবং গম দেশি মুরগির প্রিয় খাবার। এগুলো সহজেই হজম করতে পারে এবং এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পাওয়া যায়। কিন্তু অতিরিক্ত গম খাওয়ালে, দেশি মুরগির চর্বি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
- শাকসবজি: বাড়ির আশেপাশে যে কোন শাকসবজি মুরগিদের খাবারে যোগ করা যায়। দেশি মুরগি সবুজ শাক সবজি খেতে অনেক পছন্দ করে।
- গুঁড়ো খাবার: সপ্তাহে অন্তত একবার কিছু বিশেষ পুষ্টিকর গুঁড়ো খাবার, যেমন সয়াবিন মিক্স, দেওয়া উচিত।
- লেয়ার লেয়ার ১: ডিম দেয়া দেশি মুরগিকে অন্যান্য দানাদার খাবারের সাথে একবেলা লেয়ার লেয়ার ১ খাবার খাওয়াতে পারলে, ডিমের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ৫ টি ডিম দেয়া দেশি মুরগির জন্য অন্যান্য দানাদার খাবারের সাথে ২৫০গ্রাম লেয়ার লেয়ার ১ ফিড মিক্স করে দেয়া যেতে পারে।
- পানি: মুরগিক্র পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি নিশ্চিত করতে হবে। গরমের দিনে পানি পরিবর্তন করতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রয়োজনে দেশি মুরগিকে পানির সাথে ভিটামিন খাওয়ানো পড়ে দেখুন
দেশি মুরগির ঘর প্রস্তুতি
মুরগির জন্য একটি নিরাপদ ঘর খুবই জরুরি। যাতে তারা শীত ও গরম থেকে সুরক্ষিত থাকে। ঘর প্রস্তুতির জন্য নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে:
- সঠিক পরিবেশ: দেশি মুরগির জন্য ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা থাকে। দিনের বেলা সূর্যালোকও যেন ঘরে প্রবেশ করে।
- নিরাপত্তা: মুরগির ঘরে যাতে কোন প্রকার শিয়াল, ইদুর, বেজী বা বিড়াল প্রবেশ করতে না পারে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- পরিষ্কার ঘর: নিয়মিত মুরগির ঘর পরিষ্কার রাখা আবশ্যক। মুরগির ঘরে পরিষ্কার না থাকলে সহজেই রোগবালাই দেখা দিতে পারে।
দেশি মুরগির রোগ ও তার প্রতিকার
দেশি মুরগি সাধারণত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও বিভিন্ন ঋতুতে কিছু সাধারণ রোগের প্রবণতা দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- রানীক্ষেত: এ রোগের কারণে মুরগির ডিম দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রতিরোধ হিসেবে রানীক্ষেতের টিকা সময়মতো দিতে হবে।
- পোকামাকড়ের আক্রমণ: মুরগির ঘরে পোকামাকড় থেকে রোগ ছড়াতে পারে। এজন্য ঘর পরিষ্কার এবং নিয়মিত মুরগির পায়ে পাউডার ব্যবহার করা যায়।
- অ্যাভিয়ান ফ্লু: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা সাধারণত মুরগির মধ্যে দ্রুত ছড়ায়। সেক্ষেত্রে মুরগি আলাদা করে রাখা এবং পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
দেশি মুরগি পালন থেকে আয়
প্রতিদিনের গড়ে ২-৩টি ডিম এবং মাসে ৫০-৭০টি ডিম বিক্রি করা যায়। ডিম বিক্রির পাশাপাশি মাসে ১ থেকে ২টি দেশি মুরগি বাজারে বিক্রি করা হলে, আয়ের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। দেশি মুরগির মাংস এবং ডিমের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে এবং দামও ভালো পাওয়া যায়।
দেশি মুরগি পালনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
- সঠিকভাবে খাবার দেওয়া: খাদ্যের ক্ষেত্রে দেশি মুরগির জন্য সঠিক পরিমাণ এবং মান বজায় রাখা জরুরি।
- রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া: দেশি মুরগির টিকা এবং ওষুধ সময়মতো প্রদান করতে হবে।
- নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: মুরগির স্বাস্থ্য, খাদ্যাভাস, এবং ডিম উৎপাদনের হার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- বাজার যাচাই: দেশি মুরগি ও ডিমের বাজারের মূল্য এবং চাহিদা যাচাই করে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, ৫ টি দেশি মুরগি এবং ১ টি দেশি মোরগ পালন ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে একটি লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এর মাধ্যমে কম খরচে উচ্চ আয় সম্ভব এবং পরিবারের পুষ্টির যোগান দেওয়ার পাশাপাশি ছোটখাট আয় করা যায়। শুধু তা-ই নয়, দেশি মুরগির পালন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা এবং নিয়মিত যত্নই মুরগি পালনকে সফল করে তুলতে পারে।